পপির মায়ের নাম মরিয়ম বেগম। তাঁর জন্ম নড়াইলে। তবে বহুবছর আগে মরিয়ম বেগমের দারোগা পিতা সপরিবার খুলনায় গিয়ে থিতু হন। আর পপির জন্মদাতা পিতা আমির হোসেনদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনার সোনাডাঙ্গায়। অবস্থাসম্পন্ন আমির হোসেন ঠিকাদারি করতেন। সোনাডাঙ্গার বেশ প্রভাবশালী পরিবার ছিল পপিদের। একনামে এ বাড়ির সবাইকে চিনত। ৪৬ বছর আগে মরিয়ম ও আমির দম্পতির ঘর আলো করে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। তাঁর নাম রাখা হয় সাদিকা পারভীন পপি। এরপর একে একে পপির আরও তিন বোন ও এক ভাইয়ের জন্ম হয়। পপির আরও একটি ভাই এই পরিবারের সঙ্গে যুক্ত। সবার বড় সন্তান হওয়ায় পপি ছোটবেলা থেকে তাঁর ভাইবোনদের প্রতি অন্য রকম টান ছিল।
খুলনা থেকে পপির পরিবার ঢাকায় এলেও জীবনের প্রথম ভাগে ভাইবোনদের সঙ্গে তাঁর মধুর সম্পর্ক বজায় ছিল। সেই সময় পপি যেখানে শুটিংয়ে যেতেন, সেখানে তাঁর মা ছায়ার মতো সঙ্গী হয়েছেন। এমনও গেছে, মধ্যরাত, কনকনে ঠান্ডায় সিনেমার শুটিং চলছে। মা মরিয়ম মেয়ের জন্য রাতেও সেখানেই অপেক্ষায় থাকতেন। শুটিং যত রাতেই শেষ হোক, মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই মা বাসায় ফিরতেন। তখন পপির একদিকে লেখাপড়া, অন্যদিকে শুটিং। মেয়ের খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু এক হাতে দেখভাল করতেন মা।
পপির মা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিই পপিকে সিনেমায় এনেছিলাম। মেয়ের নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য অনেক কষ্ট করেছি। মেয়েও আমার অভিনয়পাগল। সে–ও অনেক কষ্ট করে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে তিনবার। সবকিছুই ভালো চলছিল। মাঝখানে কী যেন আমাদের মধ্যে ঘটে গেল। গত পাঁচ বছর পপির সঙ্গে আমার সেভাবে কোনো যোগাযোগ নেই।
দ্বন্দ্বের শুরু
মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা পপি কিশোরী বয়স থেকে দিনরাত পরিশ্রম করে তিলোত্তমা নগরী ঢাকায় নিজের একটা অবস্থান করে নেন। তাঁর সমসাময়িক অন্য জনপ্রিয় নায়িকাদের আর্থিক উন্নতির চিত্র দেখে পপি নিজের মুখোমুখি হন। হিসাব মেলাতে শুরু করেন। সেই যে নবম শ্রেণিতে কাজ শুরু, আরও পার হয়েছিল ২০ বছরের বেশি সময়।
পপি বলছিলেন, আয়ব্যয়, ব্যাংক–বিমার খোঁজ তিনি রাখতেন না। খোঁজ রাখতেন তাঁর মা–বাবা। ঢাকার বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে সংসারের অন্য সব ব্যয় তিনিই করতেন। ব্যাংকে কত টাকা জমা হলো, কোথায় কত খরচ হলো, কোনো দিন তিনি খোঁজ রাখেননি। বরং একদিন জানতে পারলেন, তাঁর পিতার সঙ্গে তার যে যৌথ ব্যাংক হিসাব ছিল, সেই হিসাবে যে অর্থ ছিল, সেটি অন্য আরেকজনের ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হয়। এই খবর শোনার পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।
কাঁদতে কাঁদতে পপি প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমি এক হতভাগা মেয়ে। নিজের হাতে ভাইবোনদের মানুষ করেছি। নিজের আয়ে মা–বাবা, পরিবার–পরিজনকে ভালো রাখতে চেষ্টা করেছি। যে মা–বাবা আমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তারাই আমার অর্থ ব্যাংক থেকে সরিয়ে ফেলবে, সেটি কোনো দিন কল্পনাও করিনি। কিন্তু বাস্তবে সেটিই ঘটেছে। আমি যখন জানলাম, আমার ব্যাংকে জমানো টাকা অন্য একজনের ব্যাংক হিসাবে দিয়ে দিল, আমি মা–বাবার কাছে কৈফিয়ত চাইলাম। কোনো জবাব পাইনি। উল্টো আমি হয়ে গেলাম শত্রু। আজও আমি তাদের কাছে শত্রু হিসেবে গণ্য হলাম।’
তবে পপির এসব অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন তাঁর মা মরিয়ম বেগম। মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করার গল্প বলতে গিয়ে বারবার তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছিলেন। তিনি বলছিলেন, পপি তো তাঁর একমাত্র সন্তান না। তাঁর আরও পাঁচটি সন্তান রয়েছে। কিন্তু পপিকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি যেভাবে দিনের পর দিন সময় ব্যয় করেছেন, অর্থকড়ি দিয়ে সহায়তা করেছেন, সেই পপি তাঁর সব অবদান অস্বীকার করবে, অসম্মান করবে, ভাত খাওয়ানোর খোঁটা দেবে—সেটি তিনি কল্পনাও করেননি।
মরিয়ম বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার তো চার মেয়ে দুই ছেলে। আমার স্বামী ছিলেন ব্যবসায়ী। সোনাডাঙ্গায় আমাদের পরিবারকে সবাই জমিদারবাড়ি হিসেবে চেনেন। আমার স্বামীর ধানি জমির পাশাপাশি শহরে বেশ কয়েক কাঠা সম্পত্তি রয়েছে। পপিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমরা একসময় ঢাকায় গিয়ে থিতু হই। আমার স্বামীর আয় ও পপির সহযোগিতায় আমরা ভালোই ছিলাম। ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছি। সবাই বিয়েশাদি করেছে। তবে আজ থেকে ১৮ বছর আগে পপির পাগলামি আমাদের পরিবারে অশান্তির জন্ম দেয়।
Leave a Reply