কক্সবাজারের চকরিয়ায় ২৩ সেপ্টেম্বর ডাকাতের হামলায় নিহত হন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ার। সাহসী এই সৈনিককে নিয়ে লিখেছেন তাঁর ক্যাডেট কলেজের বন্ধু, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) ছাত্র প্লাবন সেন
২০১৩ সালের মার্চে তানজিমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। পাবনা ক্যাডেট কলেজের মিলনায়তনে। ভর্তির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। দেখলাম ছোটখাটো একটা ছেলে সোফায় বসে গেম খেলছে। ওর আম্মু আমাকে বললেন, ‘বাবা, আমার ছেলেটা একটু ছোট তো, তোমরা একসঙ্গে মিলেমিশে থেকো।’
আমাদের ক্যাডেট লাইফ শুরু হলো। কলেজে তানজিমের ক্যাডেট নম্বর ছিল ১৮২৮। আবিষ্কার করলাম, দেখতে ছোট হলেও তানজিম কথা বলে বড়দের মতো। ক্লাস সেভেনের ট্যালেন্ট শোতে আমরা একসঙ্গে গাইলাম, ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই।’ সেই থেকে বন্ধুত্ব। আজ যখন এই লেখা লিখছি, তখন তানজিমই আর আমাদের মধ্যে নেই। সবার কাছে তাঁর পরিচয়—দেশের জন্য, জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করা বীর। যেই বীরের উচ্চতা আজ আর কোনো মাপকাঠিতেই মাপা যাবে না। আজ গর্ব নিয়ে বলতে পারি—তানজিম আমার বন্ধু, আমার হাউজমেট, আমার ভাই।
ক্লাস এইট-নাইনের একটা দীর্ঘ সময় আমার রুমমেট ছিল তানজিম। ক্যাডেট কলেজের ধরাবাঁধা নিয়মের বেড়াজালের মধ্যে থেকেই আমরা জীবনটা উপভোগ করছিলাম নিজেদের মতো করে। ক্লাস নাইনে দুজনই সাইয়েদ আব্দুল্লাহ ভাইয়ের হাউজে ছিলাম। ভাইয়া খুব স্নেহ করতেন। কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি হাউসভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতা হতো। বাগান করা, দেয়ালপত্রিকা তৈরি, খেলাধুলা, নানা কিছু। আমরা দুই বন্ধু মিলে রাতের পর রাত জেগে বিভিন্ন হাউজের কাজ করতাম।
আমার বন্ধুটির মুখে সব সময় থাকত হাসি। দল বেঁধে লুকিয়ে আম–জাম চুরি করতে যেতাম। আমাদের এই বাঁদরামি পার্টির লিডার ছিল তানজিম। কখনো ভাবিনি, ওর হাসিমুখ আর দেখা হবে না।
দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার আর তানজিমের ওপর একবার হাউজের ওয়াল ম্যাগাজিনের বুকলেটে ক্যালিগ্রাফি আর ডিজাইন করার দায়িত্ব পড়ল। সেখানে একটা নিবন্ধে বাঘের ছবি আঁকতে গিয়ে যা এঁকেছিলাম, সেটা বাঘ না গরু না অন্য কোনো প্রাণী, বোঝা যাচ্ছিল না। তানজিমের আঁকার হাত ছিল দারুণ। ছবিটা একটু ঠিকঠাক করতে তাই ওকে দিয়েছিলাম। উল্টো ছবিটাকে ও আরও মজার বানিয়ে ফেলেছিল। ওই ছবি নিয়ে আমাদের হাউজের বড় ভাইদের মধ্যে বেশ একটা হাসিঠাট্টা হয়েছিল। ভাইয়ারা ভেবেছিলেন, ছবিটা তানজিমেরই আঁকা। আমিও আসল ঘটনা চেপে গিয়েছিলাম বেমালুম। কলেজ ছাড়ার পরও ভাইদের সঙ্গে কোনো না কোনো আয়োজনে দেখা হলে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণা করে আমরা খুব মজা করতাম।
আমাদের ছোটবেলায় টিভি চ্যানেলে একটা কার্টুন শো প্রচারিত হতো। নাম ‘নিক্স—যে সব পারে’। ভালোবেসে তানজিমকে আমরা ডাকতাম ‘নিক্স’ বলে। তানজিমও যে সব পারে! গিটার থেকে বাঁশি, গান থেকে কবিতা, টেবিল টেনিস থেকে বাস্কেটবল, সুইমিং থেকে অ্যাথলেটিকস—কিচ্ছু বাদ নেই। সর্বশেষ আমার বন্ধু দেখিয়ে দিল, দেশের জন্য জীবনও দিতে পারে ও।
অ্যাথলেটিকসে আমার ১১০ মিটার হার্ডলস রেসের সঙ্গেও ছিল তানজিম। একাদশ শ্রেণিতে একবার শেষ হার্ডলে পা আটকে আমি পড়ে গেলাম, নিশ্চিত জয় হাতছাড়া হলো। তানজিম আর আরেক বন্ধু জামান এসে তুলে ধরে আমাকে শান্ত করেছিল। আজীবন ওর মধ্যে অদ্ভুত একটা ইতিবাচকতা ছিল। মানুষকে ধৈর্য ও সাহস দেওয়ার আলাদা একটা ক্ষমতা তার ছিল। আর ছিল জেদ। যে ছেলে ক্লাস নাইন-টেনে গণিতে খারাপ করল, সে-ই এইচএসসিতে বোর্ডের সেরাদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল। একটা কিছুতে জেদ চাপলে সেটা না পাওয়া পর্যন্ত থামত না। সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণের পাশাপাশিই বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতক শেষ করেছিল।
২০২১ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ৮২ লং কোর্সের একটা অনুশীলনের সময় সাঙ্গু নদে একজন অফিসার ক্যাডেট দুর্ঘটনায় ডুবে মারা যান। সেখানে উপস্থিত তানজিম কিছু না ভেবেই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সতীর্থকে বাঁচাতে। খুব সাহসী ছিল ছেলেটা, ভয়কে পাত্তা দিত না।
জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়েও নিয়মিত আমার খোঁজ নিয়েছে ও, যোগাযোগ রেখেছে। ছুটিতে এলেই দেখা করত, সাহস দিত। গত রমজান মাসেও একসঙ্গে ইফতার করেছি আমরা।
তানজিমের মতো সাহসী ছেলে খুব কম দেখেছি। অন্যায়কে অন্যায় বলতে, প্রতিবাদ করতে পিছপা হতো না। ক্যাডেট কলেজের সব শিক্ষক, সহপাঠী, সিনিয়র, জুনিয়রের খুব প্রিয় ছিল। পরিবারের খেয়াল রাখত। ছোট্ট কাঁধেই তুলে নিয়েছিল অনেক দায়িত্ব। কাছের মানুষদের যেকোনো প্রয়োজনে নির্দ্বিধায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। বাস্কেটবল খেলার খুব ঝোঁক ছিল। কলেজে, মিলিটারি একাডেমিতে সেরা খেলোয়াড় হয়েছিল। শুনেছি, সেনাবাহিনীর আন্তবিভাগ পর্যায়েও ওর খেলার কথা ছিল।
এখনো বিশ্বাস হয় না তানজিম আর নেই। মনে হয়, এই হয়তো কল করবে। বলবে, ‘মামা, তুই কই। আমি তো ঢাকায়। একবার দেখা করে যা।’
যত দিন বাঁচব, ওর হাসিমুখটা সব সময় স্মৃতিতে থেকে যাবে। ওপরওয়ালা যেন ওকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তরে স্থান দেন, এই দোয়াই করি।
সম্পাদক : নূর আলম শেখ
পুরানা পল্টন, ঢাকা-১২০০।
ইমেইল : ajkerjagaran@gmail.com
Copyright © 2025 আজকের জাগরণ All rights reserved.